ভাঁড়ের অবয়ব মনে এলে তাই অবধারিতভাবে টাকমাথায় টিকিওয়ালা পেট মোটা দারুণ এক রগুড়ে লোকের চেহারাই ভেসে ওঠে বাঙালির চোখে। তাঁর নাম অবশ্যই গোপাল ভাঁড়। কালপরম্পরায় মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত তাঁর গল্প শুনে হাসেনি এমন গোমড়ামুখো বাঙালের দেখা পেতে গেলে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো ঘটনা ঘটবে। কেননা, এখন অব্দি গোপাল ভাঁড়ই রসপ্রিয় বাঙালির মৌখিক ঐতিহ্যের যথাযোগ্য প্রতিনিধি। লোকমুখে পল্লবিত তাঁর গল্পগুলোতে চমৎকার হাসির রেখা আছে বটে, তবে ওই হাসির নেপথ্যে গুপ্তঘাতকের মতো রয়েছে মিছরির ছুরিও—এক সামন্ততান্ত্রিক সমাজকে সমালোচনার মাধ্যমে কেটে উদোম করে দেয় সেই ছুরি। আছে লোকশিক্ষা, নীতিশিক্ষা ও মোটাদাগে সমাজসংস্কারের ব্যাপার-স্যাপার। এত কিছুর পরও গোপাল বাঙালির কাছে ভাঁড় বই বেশি কিছু নয়, হাস্যরসিক এক কৌতুকপ্রিয় চরিত্র। তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে এর মধ্যেই নির্মিত হয়েছে একাধিক সিনেমা, টেলিভিশন ধারাবাহিক ও অ্যানিমেশন ছবি। এ ছাড়া কে না জানে, উনিশ শতকের শুরুতে সদ্য গঠিত নগর কলকাতায় বিপুল পসার জমানো বটতলাকেন্দ্রিক সাহিত্যের অন্যতম হাতিয়ার ছিল এই গোপাল ভাঁড়ের গালগল্প।
আজকের বাংলাদেশে গোপাল ভাঁড়ের জয়জয়কার আগের মতো নেই। তার পেছনে সামাজিক কিছু কারণ নিশ্চয়ই আছে। পাশাপাশি এ-ও ঠিক যে বাঙালির হৃদয় থেকে হাস্যরসিক এই চরিত্রটিকে মুছে দেওয়া অত সহজ নয়। কেননা, কালে কালে গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে গঙ্গা-পদ্মা-যমুনায় কম জল ঘোলা হয়নি। গোপাল ভাঁড় কে? আদতেই কি এই নামে কেউ ছিল? নাকি গোপাল একাধিকজনের সমষ্টি?
কেউ বলেছেন, রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে বাস্তবেই ছিলেন তিনি। কারও কারও কথা, গোপাল ভাঁড় নামে একক কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব খোঁজা বৃথা। কারণ, ইতিহাস তেমন সাক্ষ্য দেয় না।
গোপালের অস্তিত্বের পক্ষে-বিপক্ষের এসব প্রশ্নে যাঁরা জোর তর্ক-বিতর্ক করেছেন, সবাই বিদগ্ধজন। ফলে জল ক্রমাগত ঘোলাই হয়েছে। সেই তুলনায় বিশিষ্টদের পাশে আমরা বরং ‘অবশিষ্ট’মাত্র। অবশিষ্টরা অনেক অকাজের ওস্তাদ। সঙ্গতকারণে গোপাল ভাঁড় ছিলেন কি নেই—প্রশ্নের তদন্তে ইতিহাসের ঘোলা জলে আরেকবার সাঁতার দেওয়া যাক। তাতে হয়তো পানি আরেকটু অধিক ঘোলা হবে, এর বেশি কিছু নয়।